- আল্লামা মাহমুদুল হাসান,
আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী যেভাবে বাংলা সাহিত্যে ছাত্রদের আগ্রহী করতেন
আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী যেভাবে বাংলা সাহিত্যে ছাত্রদের আগ্রহী করতেন
আমাদের বংশে বাংলা ও ইংরেজি শিখা নিষেধ ছিল। কেউ শিখলে মুরব্বিরা তাকে বংশ থেকে বের করে দিতেন। আমাদের বংশে তাই বাংলা বা ইংলিশে কোনো উচ্চ শিক্ষিত নাই। প্রায় অর্ধশত শাইখুল হাদিস আছে, প্রায় সহস্র হাফেজে কুরআন আছে। বর্তমানে অবশ্য কিছু বাংলা ও ইংলিশে উচ্চ শিক্ষিত তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীসহ সরকারি বিভিন্ন উচ্চ পর্যায়ে কেউ কেউ চাকরি করছে। আমি জালালাইন জামাত পর্যন্ত ইংরেজি তো দূরের কথা বাংলা 'ক,খ,গ'- ও জানতামনা। জালালাইন পড়ার পর আমার চাচা মাওলানা নূরউদ্দিন ঢাকার লালবাগ মাদরাসায় ভর্তি করেন। তখন লালবাগ মাদরাসার মুহতামিম ছিলেন মুজাহিদে মিল্লাত আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী (ছদর সাহেব হুজুর) রহ.। চাচা আমাকে হুজুরের কাছে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী যেভাবে বাংলা সাহিত্যে ছাত্রদের আগ্রহী করতেন
শামসুল হক ফরিদপুরী আমাকে বাংলা শিক্ষার জন্য প্রতিদিন আছরের পর হুজুরের রুমে যেতে বললেন। আবরি ও উর্দু তখন ভালই পাড়ি। বাংলা পারি না কিছুই। তিনি আমাকে বাংলা শিক্ষার জন্য বললেন। আমি তখন বলি, বাংলা শিক্ষা করা তো আমাদের বংশে নিষেধ। হুজুর বললেন, 'এটা তো অনেক ভালো সিফাত (গুণ)। বাংলা ইংরেজি শিক্ষা করে কেউ যাতে ইংরেজ না হয় সেজন্যই মুরব্বিরা এটা বলতেন। কিন্তু বর্তমানে ইংরেজরা তো আর আমাদের দেশে নাই। এখন তাদেরকে ধরতে হলে ইংরেজি শিখতে হবে, বাংলা শিখতে হবে'। এরপর তিনি আমাকে 'বাল্যশিক্ষা' বই কিনে দিলেন। আমি প্রতিদিন আছরের পর হুজুরের কাছে  'বাল্যশিক্ষা' পড়ি। হুজুরের কাছে আমার মেশকাত, বোখারী বা অন্যকোনো কিতাব পড়া হয় নি। শুধু
'বাল্যশিক্ষা'ই পড়েছি। তিনমাস পড়ার তিনি আমাকে বললেন, ছোট এবং সহজ ভাষায় একটি মাযমুম (যেকোনো রচনা) লিখে আনতে।  যাতে সবরকম মানুষ পড়ে বুঝতে পারে।

আমি পরেরদিন রচনা লিখে হুজুরের কাছে নিয়ে গেলাম। হুজুর দেখে বলেন, 'নূরউদ্দিন ঠিকই বলেছিল, তুমি অনেক চালাক। এই রচনা তো তুমি লেখ নাই! অন্য কারো দ্বারা লিখেয়ে এনেছ। আমি বললাম, না, আমিই লেখেছি। হুজুর বললেন, 'এই রচনা তো মেট্রিক পাস ছাত্র লিখেছে মনে হয়!' হুজুর আমাকে এভাবে উৎসাহিত করতেন। এরপর হুজুর আমাকে বললেন, রচনা তো অনেক সুন্দর হয়েছে। কিন্তু এই জায়গায় ৫টি শব্দ পরিবর্তন করে এই ৫টি শব্দ লেখলে আরও ভাল হবে। আমি হুজুরের দেওয়া ৫টি শব্দ লেখলাম। এভাবে টানা ১৫দিন ৫টি করে শব্দ পরিবর্তন করালেন। শেষে দেখি আমি যে রচনা লেখেছি তা আর নাই, হুজেরর দেওয়াই সব শব্দ। এভাবে রচনাটি লেখার পর তিনি আমাকে এটি নিয়ে মাওলানা আকরাম খাঁ'র নিকট যেতে বললেন। মাওলানা আকরাম খাঁ 'দৈনিক আজাদ' পত্রিকার সম্পাদক। শামসুল হক ফরিদপুরীর সাথে তার বন্ধুত্ব সম্পর্ক ছিল, তারা একসাথেই চলতো। সাথে তিনি ইংলিশে কী-যেন দুই লাইন লিখে দিলেন। আমি হুজুরকে তা জিজ্ঞাস করেছিলাম। কিন্তু হুজুর বলে, এটি তোমার জানার দরকার নেই। মাওলানা আকরাম খাঁ'কে নিয়ে দেখাবে।

আমি মাওলানা আকরাম খাঁ'র নিকট
যাওয়ার আগে একজনের কাছে এই ইংলিশের অর্থ জিজ্ঞেস করি। তিনি বলতে চাচ্ছে না। বলে, এটা তুমি জানলে কষ্ট পাবে। আমি বলি, না কষ্ট পাব না। তখন সে বলেন, হুজুর লিখেছে যে, "ছাত্রটি খুব মেধাবী। সে বাংলা জানে না। তাকে বাংলা শিখানোর জন্য আমি রচনাটি লিখিয়েছি। তাকে উৎসাহিত করার জন্য এটি আপনার পত্রিকায় ছেপে দিন। যদি পুরোটা সম্ভব না হয়, তাহলে কাটছাঁট করে হলেও পত্রিকার যেকোনো স্থানে ছেপে দিয়েন"।
আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী যেভাবে বাংলা সাহিত্যে ছাত্রদের আগ্রহী করতেন
আমি রচনাটি নিয়ে মাওলানা আকরাম খাঁ'র নিকট গেলাম। তিনি দেখে বলেন, "এতো সুন্দর রচনা; এটি তো ছাপা হবেই। আগমিকালই পত্রিকায় দেখবেন এটি ছাপা হয়ে গেছে"। তিনি আমাকে লেখালেখির জন্য শামসুল হক ফরিদপুরী'র চেয়েও বেশে উৎসাহিত করতে লাগলেন। পরেদিন ঠিকই দেখি পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় এক কোণে রচনাটি ছাপা হয়েছে। এটিই ছিল ছাপার অক্ষরে পত্রিকায় আমার প্রথম লেখা।

শামসুল হক ফরিদপুরীর সেই অবদান আজও আমার জীবনে কাজে লাগছে। হুজেরর শিক্ষাকেই পুঁজি করে ২৫ হাজার পৃষ্ঠায় বাংলা ভাষায় স্বতন্ত্র তাফসীর 'তাফসীরে বুরহানুল কোরআন' লিখেছি। বাংলা ভাষায় আমার লেখা প্রায় ১শ' বই মার্কেটে আছে, আরও ১শ' বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত আছে। আলহাদুলিল্লাহ।

অনুলিখন: তারেক মুনাওয়ার